টার্কি মুরগি সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন | Know Details About Turkey Bird

টার্কি কি?

টার্কি মেলিয়াগ্রিস পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এক ধরনের বড় পাখি। এক সময়ের টার্কি বন্য পাখী হলেও এখন তা গৃহে বা ফার্মে পালিত বড় আকারের পাখী । বাচ্চা অবস্থায় এগুলো দেখতে মুরগির বাচ্চার মতো। মেলিয়াগ্রিস গ্যালোপাভো প্রজাতির বুনো টার্কি উত্তর আমেরিকা ও মধ্য আমেরিকার বনাঞ্চলে বসবাস করে। গৃহপালিত টার্কি এই প্রজাতি থেকে ভিন্নতর। অন্য জীবিত প্রজাতির মধ্যে মেলিয়াগ্রিস ওসেলাটা বা চক্ষু আকৃতির চিহ্নবিশিষ্ট টার্কি আবাসস্থল হচ্ছে ইউকাতান উপ-দ্বীপের বনাঞ্চলে। বিশ্বের সর্বত্র টার্কি গৃহপালিত পাখি রূপে লালন-পালন করা হয়।

কোথা হতে টার্কি আসল

যখন ইউরোপীয়রা প্রথমবারের মতো টার্কিকে আমেরিকায় দেখতে পেয়েছিল, তখন তারা ভুলবশতঃ ভাবল যে পাখিটি এক ধরণের গিনিয়া মুরগি (নুমিডা মেলিয়াগ্রিস)। পরবর্তীকালে তারা তুরস্ক দেশ থেকে মধ্য ইউরোপে পাখিটিকে নিয়ে আসে। গিনিয়া মুরগি বা গিনিয়া ফাউলকে টার্কি ফাউল নামেও ডাকা হয়। তাই, তুরস্ক দেশের নামানুসারে উত্তর আমেরিকার পাখিটির নামকরণ করা হয় টার্কি। ১৫৫০ সালে ইংরেজ নাবিক উইলিয়ামাম স্ট্রিকল্যান্ড টার্কি পাখিকে সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডে নিয়ে আসেন।

পৃথিবীর কোন কোন দেশে টার্কি পাওয়া যায়

এটি সর্বপ্রতশ গৃহে পালন শুরু হয় উত্তর আমেরিকায় । কিন্তু বর্তমানে ইউরোপ সহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশে এই পাখী কম- বেশি পালন করা হয় । বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টার্কি পাখির মাংস বেশ জনপ্রিয়। টার্কি বর্তমানে মাংসের প্রোটিনের চাহিদা মিটিয়ে অর্থনীতিতে অবদান রাখছে । এর মাংসে প্রোটিন বেশি , চর্বি কম এবং আন্যান্য পাখীর মাংসের চেয়ে বেশি পুষ্টিকর। পশ্চিমা দেশসমূহে টার্কি ভীষণ জনপ্রিয় । তাই সবচেয়ে বেশি টার্কি পালন হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ডে, ব্রাজিলে । তবে বাংলাদেশেও এখন ব্যাক্তি উদ্যোগে টার্কি চাষ শুরু হয়েছে । তৈরি হয়েছে ছোট-মাঝারি অনেক খামার। ইলেকট্রনিক মিডিয়া আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে বেকার যুবকদের অনেকেই টার্কি পালনে আহগ্রী হয়ে উঠেছেন। কিছু কিছু খামার থেকে টার্কির মাংস বিদেশে রপ্তানীর চেষ্টা চলছে। অচিরেই এ পাখির মাংশ রপ্তানী অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ধারণা করা হচ্ছে।

কেন টার্কি পাখি পালন দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে

১। টার্কির মাংস সুস্বাদু এবং মাংস উৎপাদন ক্ষমতাও ব্যাপক ।
২। এটা ঝামেলাহীন ভাবে দেশী মুরগীর মত পালন করা যায় ।
৩। টার্কি পাখি ব্রয়লার মুরগীর চেয়ে দ্রুত বাড়ে ।
৪। টার্কি পালনে তুলনামূলক খরচ অনেক কম, কারণ এরা দানাদার খাদ্যের পাশাপাশি শাক, ঘাস,লতাপাতা খেতেও পছন্দ করে ।
৫। টার্কির মাংসে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি, চর্বি কম । তাই গরু কিংবা খাসীর মাংসের বিকল্প হতে এ পাখির মাংস।
৬। টার্কির মাংসে অধিক পরিমাণ জিংক, লৌহ, পটাশিয়াম, বি৬ ও ফসফরাস থাকে । এ উপাদানগুলো মানব শরীরের জন্য ভীষণ উপকারী। এবং নিয়মিত এই মাংস খেলে কোলেস্টেরল কমে যায় ।
৭। টার্কির মাংসে এমাইনো এসিড ও ট্রিপটোফেন অধিক পরিমাণে থাকায় এর মাংস খেলে শরীওে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ।
৮। টার্কির মাংসে ভিটামিন ই অধিক পরিমাণে থাকে ।
৯। টার্কি দেখতে সুন্দর, তাই বাড়ির সোভা বর্ধন করে ।

এক নজরে টার্কি

১। ডিম দেয়া শুরুর বয়স ৩০ সপ্তাহ ।
২। পুরুষ ও স্ত্রীর অনুপাত ১ :৪ অথবা ১:৫ থাকলেই চলে।
৩। বছরে গড়ে ৮০ থেকে ১০০টি ডিম দেয়।
৪। ডিম ফুটে বাচ্চা বেড় হয় ২৮ দিনে ।
৫। ২০ সপ্তাহে পুরুষ পাখীর গড় ওজন হয় ৬-৭ কেজি এবং স্ত্রী পাখীর ৩-৪ কেজি ।
৬। ১৪ থেকে ১৫ সপ্তাহই পুরুষ পাখির বাজারজাত করনের সঠিক সময়। আর স্ত্রী পাখীর ১৭-১৮ সপ্তাহ ।
পূর্ণাঙ্গ পুরুষ জাতীয় টার্কির মাথা ন্যাড়া থাকে। সাধারণতঃ এর মাথা উজ্জ্বল লাল রঙের হয়। কখনো কখনো সাদা কিংবা উজ্জ্বল নীলাভ রঙেরও হয়ে থাকে থাকে। পুরুষ টার্কি পাখি গবলার বা টম নামেও পরিচিত। এগুলো গড়ে লম্বায় ১৩০ সে.মি. বা ৫০ ইঞ্চি হয়। গড়পড়তা ওজন ১০ কেজি বা ২২ পাউন্ড হতে পারে। কিন্তু স্ত্রী জাতীয় টার্কি সাধারণতঃ পুরুষ পাখির তুলনায় ওজনে অর্ধেক হয়। বন্য টার্কি আত্মরক্ষার্থে দ্রুত দৌড়িয়ে গা ঢাকা দেয়। কিন্তু এটি স্বল্প দূরত্বে উড়তে পারে।

ডিম উৎপাদন

সাধারণত ৩০ সপ্তাহ বয়স থেকে টার্কি ডিম দেয়া শুরু করে । প্রতিটি স্ত্রী জাতীয় টার্কি প্রতিবাওে ৮ থেকে ১৫টি ছোট ছোট দাগের বাদামী বর্ণাকৃতির ডিম পাড়ে। ডিমের আকার আমাদের দেশের হাঁসের ডিমের আকৃতির হয়ে থাকে। ২৮ দিন অন্তর ডিম ফুটে বাচ্চা টার্কি জন্মায়।
প্রয়োজনীয় আলো বাতাস, পরিষ্কার পানি এবং খাবার সরবরাহ করা হলে বছরে ৮০-১০০ ডিম দিয়ে থাকে । ৬০-৭০ শতাংশ টার্কি মুরগী বিকেল বেলায় ডিম দেয় ।

টার্কি লালন পালন

শেড
টিন, ছন, খড়ের ছাদ দেয়া ঘর বা কনক্রিট দালানে টার্কি পাখি পালন করা যায়। টার্কি পাখি মুক্ত অবস্থায় ও আবদ্ধ অবস্থায় পালন করা যায় ।
একটি টার্কির জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার তালিকা নিচে দেয়া হলো
বয়স জায়গা (ব.ফু) খাদ্যের পাত্র (সে.মি.) পানির পাত্র (সে.মি.)
০-৪ সপ্তাহ ১.২৫ ব.ফু ২.৫ সে.মি. ১.৫ সে.মি.
৫-১৬ সপ্তাহ ২.৫ ব.ফু ৫.০সে.মি. ২.৫ সে.মি.
১৬-১৯ সপ্তাহ ৪.০ ব.ফু ৬.৫ সে.মি. ২.৫ সে.মি.
প্রজননক্ষম ৫.০ ব.ফু ৭.৫ সে.মি. ২.৫ সে.মি.
লিটার ব্যবস্থাপনা
এই পদ্ধতিতে টার্কির জন্য সহজলভ্য দ্রব্য ব্যাবহার করা যায় । যেমন নারিকেলের ছোবড়া, পূর্ণ তুষ (কেনো ভাবেই ধানের কুড়া নয়) । প্রথমে ২-৩ ইঞ্চি পুরু লিটার তৈরি করতে হয় । পরে আস্তে আস্তে আরো উপাদান যোগ করে ৩ – ৪ ইঞ্চি করলে ভালো হয় । লিটারে সব সময় শুকনো দ্রব্য ব্যবহার করতে হবে । ভিজা লিটার তুলে সেখানে আবার শুকনো লিটার দিয়ে পূর্ণ করতে হবে ।
টার্কি পাখির কি খায়
বন্য টার্কি সাধারণতঃ বনভূমিতে পানির কাছাকাছি এলাকায় থাকতেই বেশি পছন্দ করে। ফসলের বীজ, পোকামাকড় এবং মাঝেমাঝে ব্যাঙ কিংবা টিকটিকি খেয়েও এরা জীবনধারণ করেন।
গৃহপালিত বা খামারে যারা টার্কি পালন করছেন তারা মোট খাবারের ৫০ ভাগ সবুজ ঘাস, শাক (পালং, সরিষা, কলমি, হেলেঞ্চা, সবুজ ডাটা, কচুরিপানা দিবেন। একটি পূর্ণ বয়স্ক টার্কির দিনে ১৪০- ১৫০ গ্রাম খাবার দরকার হয় । যেখানে ৪৪০০- ৪৫০০ ক্যালোরি নিশ্চিত করতে হবে । এছাড়া বয়লার বা লেয়ার মুরগীর খাবারও এরা খেয়ে থাকে।
সতর্কতা: শাকে অনেক সময় কীটনাশক থাকে। তাই শাক দেয়ার আগে এগুলো এক ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর তা কেটে খাওয়াতে হবে।
টার্কির খাবার সরবরাহের জন্য দুইটি পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় । যেমন ম্যাশ ফিডিং ও পিলেট ফিডিং ।
একটি আদর্শ খাদ্য তালিকা নিচে দেয়া হলো:
ধান ২০%
গম ২০%
ভুট্টা ২৫%
সয়াবিন মিল ১০%
ঘাসের বীজ ৮%
সূর্যমুখী বীজ ১০%
ঝিনুক গুড়া ৭%
মোট ১০০%

সতর্কতা

অন্যান্য পাখির তুলনায় টার্কির জন্য বেশি ভিটামিন, প্রোটিন, আমিষ, মিনারেলস দিতে হয়। কোন ভাবেই মাটিতে খাবার সরবরাহ করা যাবে না । সব সময় পরিষ্কার পানি দিতে হবে ।
প্রজনন ব্যবস্থা
একটি বড় টার্কি পাখির জন্য ৪- ৫ বর্গ ফুট জায়গা নিশ্চিত করতে হবে । ঘরে পর্যাপ্ত আলো ও বাতাসের ব্যবস্থা থাকতে হবে । ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে । একটি মোরগের সঙ্গে ৩ বা ৪ টি মুরগী রাখা যেতে পারে । ডিম সংগ্রহ করে আলাদা জায়গায় রখতে হবে । ডিম প্রদানকালীন সময়ে টার্কিকে আদর্শ খাবার এবং বেশি পানি দিতে হবে ।
বাচ্চা ফুটানো
টার্কি নিজেই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায় । তবে দেশী মুরগী অথবা ইনকিউবেটর দিয়ে বাচ্চা ফুটালে ফল ভালো পাওয়া যায় । তাছাড়া বাচ্চা উৎপাদনের জন্য সময় নষ্ট না হওয়ার কারণে টার্কিও ডিম উৎপাদন বেশি করে ।
রোগ বালাই
পক্স, সালমোনেলোসিস, কলেরা , রানিক্ষেত মাইটস ও এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বেশি দেখা যায় । পরিবেশ ও খামার অব্যবস্থাপনার কারণে অনেক রোগ সংক্রমণ হতে পারে ।
টিকা প্রদান
১ম দিন এন ডি ( বি১ স্টেরেইন )
৪ ও ৫ সপ্তাহে ফাউল পক্স
৬ সপ্তাহে এন ডি
৮-১০ সপ্তাহে ফাউল কলেরা
সতর্কতা
কোন অবস্থায় রোগাক্রান্ত পাখিকে টিকা দেয়া যাবে না। টিকা প্রয়োগ করার পূর্বে টিকার গায়ে দেয়া তারিখ দেখে নিবেন। মেয়াদ উত্তীর্ণ টিকা প্রয়োগ করবেন না ।
এছাড়া নিয়ম মাফিক, পরিচ্ছন্ন খাদ্য ও খামার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অনেক রোগ বালাই এড়িয়ে চলা সম্ভব ।

বাজার সম্ভাবনা

আমাদের দেশে
টার্কির মাংস পুষ্টিকর ও সুস্বাদু হওয়ায় এটি খাদ্য তালিকার একটি আদর্শ মাংস হতে পারে । পাশাপাশি দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাংসের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে। যাদের অতিরিক্ত চর্বি যুক্ত মাংস খাওয়া নিষেধ অথবা যারা নিজেরাই এড়িয়ে চলেন, কিংবা যারা গরু/ খাসীর মাংস খায়না, টার্কি তাদের জন্য হতে পারে প্রিয় একটি বিকল্প । তাছাড়া বিয়ে, বৌ-ভাত, জন্মদিন সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খাসীর/গরুর মাংসের বিকল্প হিসেবে টার্কির মাংস হতে পারে অতি উৎকৃষ্ট একটি খাবার। এবং গরু/ খাসীর তুলনায় খরচ ও হবে কম ।
বাণিজ্যিক খামার করলে এবং মাংস হিসেবে উৎপাদন করতে চাইলে ১৪/১৫ সপ্তাহে একটি টার্কির গড় ওজন হবে ৫/৬ কেজি । ৪০০ টাকা কেজি দর হিসেব করলে একটি টার্কির বিক্রয় মূল্য দাঁড়াবে ২০০০/২৫০০ টাকা। ১৪/১৫ সপ্তাহ পালন করতে সর্বোচ্চ খরচ পরবে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা । তাহলে কমপক্ষে একটি টার্কি থেকে ৫০০ টাকা লাভ করা সম্ভব।
বর্তমানে ছোট আকারের খামার করার যে চাহিদা দেশব্যাপী তৈরি হয়েছে, তাতে আগামী ৩/৪ বছরে কয়েক লাখ টার্কির প্রয়োজন হবে। এবং সে ক্ষেত্রে দাম ও বেশি পাওয়া যাচ্ছে । ৩০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত বয়স ও রং ভেদে টার্কির জোড়া কেনা বেচা চলছে ।
টার্কির মাংস রপ্তানী
পৃথিবী বিভিন্ন দেশে টার্কির মাংস রপ্তানী সেই দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ব্রাজিল ২০১৫ সালে ১৩২৯০০ টন টার্কির মাংশ বিদেশে রপ্তানী করে। (সূত্র: ব্রাজিল এসোসিয়েশন অব এনিম্যাল প্রোটিন) । টার্কি পাখির খাদ্য সবুজ ঘাস, শাক লতাপাতা বাংলাদেশে সহজলভ্য। দেশে গড়ে উঠছে অসংখ্য ছোটবড় খামার। তাই বাংলাদেশও টার্কির মাংশ রপ্তানীতে অচিরেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে অনেকে মনে করছেন। এক্ষেত্রে সরকারি সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।


টার্কি বাচ্চার দাম,
টার্কি মুরগির খাবার, 
টার্কি মুরগির দাম, 
টার্কি মুরগির খামার,
টার্কি মুরগির রোগ,



Related product you might see:

Share this product :

Post a Comment