বাংলাদেশে টার্কির আন্তঃপ্রজনন বা ইনব্রীডিং | Interbreeding or inbreeding of turkey in Bangladesh



জনাব আদিব সাহেব টার্কি পালণে আকৃষ্ট হয়েছিল এর সৌন্দর্য্য ও মাংশ উৎপাদন ক্ষমতার কথা শুনে। সে শুনেছিল একটা টার্কি নাকি ১২-১৫কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিন্তু টার্কি পালন করতে গিয়ে দেখল তার টার্কিগুলো ৬-৭কেজির বেশী হচ্ছেইনা। এর মধ্যে আবার নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে-প্রত্যেক ব্যাচেই কিছু বাচ্চা বিভিন্ন ডিসঅর্ডার নিয়ে জন্ম নিচ্ছে। সে তখন ভাবল হয়তো তার ফুড ম্যানেজমেন্টে বা অন্য কোন ত্রুটি আছে। কি কি ত্রুটি থাকতে পারে সেগুলো খুজে বের করার চেষ্টা করতে লাগল।
এদিকে বাংলাদেশে টার্কির মাংশের বাজার আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ আর এখন আগের মত প্রশ্ন করেনা টার্কি কি খাওয়া যায় নাকি ? দেশের বিভিন্ন সুপারসপ ও কিছু কিছু স্থানীয় বাজারেও টার্কির মাংশ বিক্রি হচ্ছে। টার্কির মাংশের ভোক্তা তৈরি হচ্ছে দেখে আদিব সাহেব তার দূরদর্শিতা থেকে চিন্তা করতে লাগল কিভাবে একটা টার্কি থেকে আরো বেশী পরিমাণ মাংশ উৎপাদন করা যায়?
ঠিক এমন একটা সময় সে জানতে পারল বাংলাদেশে এখন হাইব্রীড বা দ্রুতবর্ধনশীল জাতের টার্কি পাওয়া যাচ্ছে, যার একেকটির ওজন নাকি ৩০কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। তথ্যটি পাওয়ার পর আদিব সাহেবের মাথা হতে এক রাস চিন্তা খুব সহজেই উবে গেল। আদিব সাহেবের নিজেকে খুব হালকা হালকা ফ্রেস লাগল। এই তাহলে গুড় রহস্য ? তার টার্কি হাইব্রীড নয় এজন্যই কি খর্বাকায় ও যতই ভাল খাবার দেয়া হচ্ছে ওজন বাড়ছেনা।
আদিব সাহেব এবার হাইব্রীড টার্কি সংগ্রহের জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। অনেক খুঁজেপেতে সে সন্ধান পেল বাংলাদেশের কোথায় হাইব্রীড টার্কি আছে। আদিব সাহেব অনেক টাকা ব্যয় করে কিছু হাইব্রীড টার্কির বাচ্চা সংগ্রহ করল। কিছুদিন যেতেই বাচ্চাগুলোর গ্রোথ দেখে তার চোঁখ চকচকে হয়ে উঠল। মানসিক ভাবে খুবই প্রশান্তি লাভ করল। এই না হলে টার্কি ? কেমন তর তর করে বেড়ে উঠছে। কয়েক মাসেই তার টার্কি গুলো কেনার আগে গল্প শুনা ৩০কেজি না হলেও ১২-১৪কেজি হয়ে গেল।
আদিব সাহেব এবার ভাবতে লাগল যাক বাবা ভালয় ভালয় হাইব্রীড টার্কিগুলো বড় হয়ে ডিম দেয়া শুরু করলে তাকে আর পায় কে ? ডিম হতে বাচ্চা, বাচ্চা বড় হয়ে মাংশ বিক্রি করেই লালে লাল, আর ওদিকে বোনাস হিসেবে বাচ্চা বিক্রিতো আছেই।
দির্ঘ প্রতিক্ষার পর আদিব সাহেবের স্বপ্নের দিন আসন্ন। আদিব সাহেবের কেনা হাইব্রীড টার্কিগুলো ডিম দেয়া শুরু করল। অনেক অনেক আশা নিয়ে আদিব সাহেব ডিমগুলো ইউটিউব চ্যানেলের টিউটোরিয়াল দেখে নিজের বানানো ইনকিউবেটরে ফুটানোর জন্য দিল। এবার শুধু ২৮দিন প্রতিক্ষার পালা। যাইহোক আদিব সাহেব ডিম গুলো হতে আশানুরূপ বাচ্চা পেল। সে খুবই সন্তুষ্টচিত্তে বাচ্চা ব্রুডিং শুরু করল।
অতঃপর কিছুদিন যেতেই সে লক্ষ্য করল যে, তার বাচ্চা গুলো তাদের বাবা-মার মত অতটা দৈহিক বৃদ্ধি পাচ্ছেনা। বাচ্চা গুলো কেমন শীর্ণ, খর্বাকায় ও দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। আদিব সাহেব ভিষণ চিন্তায় পড়ে গেল। সে ভাবল তার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। সে স্থানীয় ভেটনারী ফার্মেসীতে গেল পরামর্শের জন্য।ফার্মেসীর ঔষধ বিক্রেতা কিছু না বুঝেই তাকে একগাদা ঔষধ ধরিয়ে দিল। আদিব সাহেব হতাশ হল এর কোন প্রতিকার না পেয়ে।
হঠাৎই তার মনে পরল তার ফেসবুক ফ্রেন্ড লিস্টে হাজী মুহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স রিসার্চ বিভাগের সম্মানীত ড.Gaffar Miah স্যার রয়েছে। আদিব সাহেব এবার স্যারের সাথে চ্যাটিং ও পরবর্তীতে মোবাইল ফোনে বিস্তারিত জানাল। স্যার আদিব সাহেবের সমস্ত কথা শুনে আদিব সাহেবের টার্কিতে ইনব্রীডিং সমস্যা থাকার সম্ভাবনার কথা জানালেন।
আদিব সাহেব চিন্তায় পড়ে গেলেন ইনব্রীডিং সেটা আবার কি? এতবছর ফার্ম করছি ইনব্রীডিং বলে কিছু আছে এটাতো শুনিনি। আদিব সাহেব এবার বিষয়টি নিয়ে স্টাডি শুরু করল এবং জানতে পারল-
ইনব্রিডিং (Inbreeding) বা অন্তঃপ্রজনন হচ্ছে রক্ত সম্পর্কের নিকটাত্মীয়ের মধ্যে প্রজনন প্রক্রিয়া। অর্থাৎ কাছাকাছি জিনের মধ্যে মিলনের ফলে যে সন্তান জন্ম নিচ্ছে সেটাই ইনব্রিডিং।
জেনেটিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিকট সম্পর্কযুক্ত পিতামাতা হতে প্রজন্মের সৃষ্টি। যেমন: ক) ভাই + বোন = ইনব্রিড, খ) মা + ছেলে = ইনব্রিড, গ) বাবা + মেয়ে = ইনব্রিড
এভাবে বংশ পরম্পরায় যদি হতে থাকে সেটা ইনব্রিডিং।
আদিব সাহেব এবার মস্তবড় খটকায় পরে গেল। ছোটবেলা হতে দেখে এসেছে গ্রামের গৃহস্থ তার পালের সবচেয়ে বড় মোরগটিকে রেখে দেয় পরবর্তী বংশবৃদ্ধির জন্য। আবার ছাগলের বেলায় দেখেছে একি পাঠা দিয়ে বছরের পর বছর মা, মেয়ে, নাতনী সবাইকে প্রজনন করাচ্ছে। তাহলেতো সারা দেশ জুড়েই ইনব্রীডিং রয়েছে।
আমাদের দেশের দেশী, হাঁস, মুরগি, ছাগল, ভেড়া, দেশী গরু কোন প্রানীতে নাই ইনব্রিডিং? তাহলে ইনব্রীডিং এর কুফলটা কি??
ইনব্রিডিংয়ের কুফল:
মানুষের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক বিয়ে ইসলামে নিষিদ্ধ। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ হতেও নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে বিজ্ঞানসম্মত নয়। এমনকি চাচাতো, মামাতো, খালাতো ও ফুফাতো ভাই-বোনদের মধ্যে বিয়ের ফলে যে সন্তান হয়, তার মধ্যে জন্মগত ও স্বাস্থ্য ত্রুটি দেখা দেয়ার ঝুঁকি বেশি। নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের মাধ্যমে জন্মগ্রহণকারী সন্তানের জিনগত অস্বাভাবিকতার হার এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি সাধারণ শিশুদের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি।
প্রাণীদের ক্ষেত্রে ভাইবোন প্রজননে প্রতি জেনারেশনেই ২৫% জেনেটিক গুনাগুন হ্রাস পায়। পরিবর্তিত পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতাও কমে যেতে থাকে। ইনব্রিডিংয়ের ফলে স্পার্ম বা শুক্রাণুর মানের উপরে প্রভাব ফেলে। এদের শুক্রাণু ডিম্বাণুকে নিষিক্ত না করতে পারার অনুপাত ১০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে। বংশগতির সাধারণ সূত্রানুসারে পুরুষ ও স্ত্রী দুজনেরই যদি একই জীন লুকায়িত (Recessive) থাকে তাহলে শতকরা ২৫ ভাগের মতো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সম্ভাবনা থেকে যায় ত্রুটিপূর্ণ জেনেটিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সন্তান জন্মানোর এবং ৫০% সম্ভাবনা থাকে এ জীনের বাহক হওয়ার। সমস্ত প্রানীজগতের বিষয়টি একই রকম।
প্রাণীতে ইনব্রিডিং হলে যা ঘটে:
১) উন্নত জাত আস্তে অনুন্নত জাতে রূপান্তরিত হয়।
২) শাররীক বৃদ্ধির হার খুবই কম ও দূর্বল প্রকৃতির হয় এবং খর্বাকৃতি আকারের হয়।
৩) জন্মগত ত্রুটি, শাররীক বিকলাঙ্গতা চলাফেরা অসামঞ্জস্যতা, বাঁকা মুখমন্ডল বা চোখ ডাবানো হয়।
৪) জন্মগত প্যারালাইসিস বেড়ে যায়।
৫) বাঁকা পা বা পায়ের গড়ন অস্বাভাবিক হয়।
৬) বাঁকা ঠোঁট হতে পারে।
৭) স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট চোখ হতে পারে।
৮) এক বা দুইটি চোখই না ফোটতে পারে।
৯) পা একটি ছোট আরেকটি কিছুটা বড় হতে পারে।
১০) জন্ম অন্ধত্ব।
১১) স্নায়ুকোষের ক্ষয় হতে থাকে।
১২) নবজাতক বাচ্চার উচ্চ মৃত্যুহার।
১৩) নিম্নতর জন্ম ওজনে জন্ম নেয়া।
১৪) ডিম ও মাশেংর উৎপাদন কম হওয়া।
১৫) শুক্রাণুর উর্বরতা কমে যাওয়া।
১৬) দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
১৭) পুরুষ প্রাণীর প্রজনন ক্ষমতা না থাকা অর্থাৎ বন্ধাত্ব।
১৮) পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারা।
১৯) প্রতি জেনারেশনেই ২৫% জেনেটিক গুনাগুন হ্রাস পায়।
আদিব সাহেব এবার ভাবতে লাগল তাহলে এটাই প্রকৃত কারন যার জন্য তার টার্কিকে ভালমানের খাবার দিয়েও আশানুরূপ ফলাফল পাচ্ছেনা। আবার হাইব্রীড গুলোরও বাচ্চার আকার ছোট হয়ে যাচ্ছে। তাহলে উপায় কি?
সে স্টাডী করে দেখল উপায় একটা আছে মনে হচ্ছে, তা হল:আউট ব্রীডিং।
এটা আবার কি? আসুন তাহলে জেনে নেই -
যাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক নাই তাদের মিলন হল আউটব্রিডিং (outbreeding) পদ্ধতি। এপদ্ধতিতে চমৎকার, শক্তিশালি, উর্বর, সুস্থ, বাচ্চা জন্মায়। আউটব্রিড প্রাণী হতে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন পাওয়া যায়। তাই আউট ব্রিডিংয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
ইনব্রিডিং থেকে মুক্ত থাকার উপায়:
ক) রক্তের সম্পর্কের মধ্য প্রজনন না করানো।
গ) একই পুরুষ প্রাণী পুনঃপুনঃ প্রজনন কাজে ব্যবহার না করা।
ঘ) প্যারেন্টস স্টক তৈরির ক্ষেত্রে একই ফার্ম হতে বেশী পরিমাণ টার্কি সংগ্রহ না করা।
ঙ) ইনব্রীডিং সম্পর্কে যে ফার্মারের ধারনা নাই, প্যারেন্টস তৈরির ক্ষেত্রে এসব ফার্ম হতে বাচ্চা সংগ্রহ এড়িয়ে চলা।
চ) সিলেক্টেড ব্রীডিং করানো।
ছ) প্রত্যেকটি প্যারেন্টস এর রেকর্ড সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।
জ) ব্লাড ভিন্ন করার জন্য বিভিন্ন ফার্ম হতে যেমন: এক ফার্ম হতে শুধু পুরুষ, অন্য ফার্ম হতে শুধু মহিলা সংগ্রহের চেষ্টা করা।
ঝ) হাইব্রীড পুরুষ টার্কির সাথে লোকাল মহিলা টার্কির মিলন ঘটিয়ে জাতোন্নয়ন করা যেতে পারে।
★★বিঃদ্রঃ★★
ইনব্রীডিং এখনো বাংলাদেশের টার্কি সেক্টরে তেমন একটা দেখা না দিলেও, অধিকাংশ ফার্মারের এসম্পর্কিত সঠিক ধারনা না থাকায় হয়তো অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এটি ব্যাপক আকার ধারন করবে বলে লেখকের ধারনা। তাই এখনি সময় সচেতন হওয়ার।
পুনশ্চ :
সকলের সুপরামর্শ ও সহযোগীতা কাম্য। কারো সাথে মতের অমিল হলে এড়িয়ে যাওয়ার অনুরোধ রইল।


Related product you might see:

Share this product :

Post a Comment