সৌখিনতা বশত টার্কি পালন করুন | Pet Turkey Hen For Amateur


আদিব সাহেবের ছেলেবেলা থেকেই পশু পাখীর প্রতি অদম্য ঝোঁক। এটা সে পেয়েছে জিন এবং ডিএনএ এর কল্যাণে বংশগত ভাবে। কারন তার দাদা একসময় শখের বশে কবুতর পালতেন। তার বাবা শৈশবে গ্রামের হেন কোন বন-বাদার নেই যেখানে পাখীর ছানা সংগ্রহের চেষ্টায় ধাপিয়ে বেড়াননি।নিজের বাবাকে দেখে কৈশরে এসে কবুতরের প্রেমে পরে যান তার বাবা। কিন্তু পারিবারের সদস্যদের চাপে তা আর বেশী দূর এগোতে পারেনি।
আদিব সাহেবের বাবার মুখে শুনা ছেলেবেলায় যখন তার বয়স ছিল মাত্র ১.৫ বছর, সেই সময়ই সে মুরগী, কবুতর দেখলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। পাড়ার কেউ যদি কোলে নিয়ে আদর করতে চাইত খুব সহজে সে তার কোলে যেতনা। কিন্তু কেউ যদি মুরগীর ছোট ছানা নিয়ে আসতো অমনি সে ধরতে যেত এবং কোলে যেত। বাল্যকালে সব বাবা-মারা যখন তাদের বাচ্চাদের “টম এন্ড জেরী” দেখিয়ে খাবার খাওয়াত, আদিব সাহেব তখন ডিসকভারী বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফী চ্যানেল ছাড়লে হা করে তাকিয়ে দেখত।
আদিব সাহেব যখন কৈশোরে পৌছল তখন পরিবারের শত অনিচ্ছা সত্যেও সে কিছু কবুতর কিনেই ফেলল। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই পরিবারের তীব্র বাঁধায় পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটবে এই অজুহাতে সবকিছু পন্ড হয়ে যায়। বাধ্য হন তিনি সব কবুতর বিক্রি করে দিতে।
কিন্তু আদিব সাহেবের অবস্থা হচ্ছে সেই চিরচেনা গানের লিরিক-“মানুষ আমি আমার কেন পাখীর মত মন, তাইরে নাইরে করে কাটে সারাটি জীবন”। বিশ্ববিদ্যালয়েই যাক আর বন্ধুদের সাথে আড্ডায়ই যাক তার নজর থাকে আকাশের দিকে। কোথায় একটি কবুতর উড়ছে, কোন বাসার ছাদে একটি সুদৃশ্য বাম আছে, কোন মহল্লার কোন বাসা থেকে পাখীর কিচির মিচির শব্দ ভেসে আসে।
বিভিন্ন চ্যানেলের কৃষিভিত্তিক প্রোগ্রামগুলো তার খুব ভাল লাগতো। এক শীতের অলস দুপুরে ভাত ঘুমের প্রস্তুতি নিতে নিতে টিভির রিমোট ঘুরাতে ঘুরাতে হঠাৎ তার চোখে পরল অদ্ভূত সুন্দর এক ভীনদেশী পাখী যা বাংলাদেশে কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক সারা ফেলছে। ফ্রেন্সকাট দাড়ি, মাথার মধ্যভাগ দিয়ে সিথী এক নওজোয়ান নাম তার টার্কি মিরাজ, সে টার্কি পালণ সম্পর্কে কথা বলছে। আদিব সাহেব ভাবতে থাকে টার্কি মিরাজ সেটা আবার কেমন নাম ? কৌতুহল মেটাতে গিয়ে সে জানতে পারল ভিনদেশী পাখী টার্কিকে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিতি এনে দেয়ায় তার নামের টাইটেল হয়ে গেছে টার্কি মিরাজ।
আদিব সাহেবের অসম্ভব ভাল লেগে যায় এই টার্কি নামক পাখীটাকে। যেমনি বাহারী দেখতে, তেমনি তার আকার। আদিব সাহেবের তখন অবস্থা এমন হল যে- “তোরা যে যাই বলিস ভাই, আমার কিন্তু টার্কি এখন চাই”। সৌখিনতা যার রক্তে মিশে আছে তাকে আর কতদিন ঠেকিয়ে রাখবে পরিবার। সৌখিনতার তীব্র মানসিকতা নিয়ে জন্ম নেয়া আদিব সাহেব জীবনে কোনদিনও কোন প্রাণী লালণ পালণের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই শুধুমাত্র শখের বসে হুট করে একদিন ফেসবুকের কল্যাণে অল্পকিছু টার্কি জোগাড় করেই ফেলল।
কিন্তু হায় সে টার্কিগুলো রাখবে কোথায় ? বাড়ির ছাদে নাকি চিলে কোঠায় ? ভেবে দেখে সিড়ির নিচেও কিছু জায়গা আছে। অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নিল চিলে কোঠার ফ্লোরে একটি খাচায় রাখবে টার্কির বাচ্চা গুলো। কিন্তু আবার চিন্তা বাচ্চা পাখীর জন্য কি ধরনের খাবার উপযোগী সেটা নিয়েও ভাবনার শেষ নেই।পরিবারের সদস্যরা এবং কৌতুহল বশত প্রতিবেশীরা তার আজব পাখী দেখতে ভীড় করল। এবং দিন দিন ভীড় বাড়তেই লাগল।
কিছুদিন যেতে না যেতেই টার্কি গুলোর বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে লাগল।
• ঝিম ধরে বসে থাকে খাবার খায়না।
• নাক মুখ ফুলে গেল।
• চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগল।
• তীব্র শ্বাস কষ্ট হতে লাগল।
আদিব সাহেব অবস্থা সংকটময় দেখে ফেসবুকে টার্কির কিছু গ্রুপে টার্কির ছবিসহ হেল্প পোষ্ট দিল।
কয়েক ঘন্টার মধ্যেই কমেন্টের পর কমেন্টে বিভিন্ন মেডিসিন আর ব্যবস্থাপত্রের হিড়িক পরে গেল। এ বলে এটা খাওয়ালে ভাল হবে ও বলে ওটা খাওয়ালে ভাল হবে। আদিব সাহেব কোনকিছু না বুঝেই কয়েকদিনের মধ্যেই প্রায় সকলের দেয়া ব্যবস্থাপত্র গুলো প্রয়োগ করে ফেলল। অবস্থা দিন দিন আরো গুরুতর হতে লাগল। অবশেষে টার্কিগুলো একটার পর একটা মরতে লাগল।
আদিব সাহেব শখের অকাল মৃত্যু হওয়ায় দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে একটি স্যাড পোষ্ট দিল। আর এক শ্রেণীর স্বার্থলোভী অতিউৎসাহী ব্যক্তিবর্গ আদিব সাহেবের ভুল গুলো খুজে বের না করে তার শখের অকাল মৃত্যকে উপজীব্য করে শুধুমাত্র ব্যবসায়ীক স্বার্থে গলাবাজী, চাপাবাজী, দলবাজী আর নোংরা প্রতিযোগীতায় নেমে পরল।
----
আসুন আমরা এখন দেখে নেই আদিব সাহেবের ভুল গুলো কি ছিলঃ
• তীব্র সৌখিনতার মানসিকতা থাকা সত্ত্বেও কোন প্রাণী, বিশেষ করে পাখী জাতীয় প্রাণী পালণের কোন অভিজ্ঞতাই তার ছিলনা।
• পাখীর বাসস্থান সম্পর্কে সঠিক ধারনা তার ছিলনা।
• পাখীর খাবার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কেও তার স্বচ্ছ ধারনা ছিলনা।
• জৈব নিরাপত্তা সম্পর্কে তার কোন ধারনা ছিলনা। বাড়ির লোকজন ও প্রতিবেশিরা কোনরকম জীবানুনাশক স্প্রে না করেই তার পাখী গুলোর কাছে আসে যা রোগ ছড়ানোর জন্য যথেষ্ট উপযোগী।
• আদিব সাহেব টার্কি কিনেছিল শীতকালে তার উপর আবার রেখে ছিল চিলে কোঠায়। বাচ্চাকে কৃত্রিম তাপ কিভাবে কতটুকু দিতে হয় সেটা সে জানতনা।
• শীতকালে চিলে কোঠায় রাতে তাপমাত্রা একদম কমে যায় ফলে তীব্র শীতে বাচ্চার ঠান্ডা লেগে যায়।
• ফ্লোর ছিল স্যাতস্যাতে আর ফ্লোর থেকেও ঠান্ডা উঠত।
• সে ফেসবুকে হেল্প পোষ্ট দিলে অনেকে অনেক রকম মেডিসিনের নাম বলে আর আদিব সাহেব কিছু না বুঝেই সেগুলো তার পাখীর উপর প্রয়োগ করেন। ফলে সঠিক রোগ নির্ণয় না হওয়ায় ও অতিরিক্ত ঔষধ প্রয়োগের ফলে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় বাচ্চাগুলো নির্জীব হয়ে পরে।
শিক্ষাঃ
(১) শখের বশে কোন কিছু পালণের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া টার্কি কিনলে আপনার অবস্থাও আদিব সাহেবের মত হতে পারে।
(২) টার্কির বাচ্চা ক্রয়ের পূর্বে এর খাবার ব্যবস্থাপনা, বাসস্থান, জৈব নিরাপত্তা, রোগ ও প্রতিকার সম্পর্কে ভাল করে জেনে নিন।
(৩) ছোট বাচ্চার ব্রুডিং সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করুন।
(৪) জৈব নিরাপত্তার উপর স্টাডি করুন ও প্রয়োগ করুন।
(৫) কথায় আছে নানা ঋষির নানা মত। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন পরামর্শ মত ঔষধ প্রয়োগ করা কিছুতেই ঠিক নয়।
(৬) অধিক সন্নাসীতে গাজন নষ্ট। আপনি ভিন্ন জনের পরামর্শ গ্রহণ না করে পশু চিকিৎসক অথবা কোন একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ মত ঔষধ প্রয়োগ করুন।
(৭) টার্কি পালণের আগে অভিজ্ঞ ভাইদের সাথে যোগাযোগ করুন। তাদের ফার্ম ভিজিট করুন।
(৮) ভার্চুয়াল মাধ্যম হোক আর ম্যানুয়ালই হোক জ্ঞানার্জন করুন।
(৯) কোন কারনে আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হলে আগে খুজে বের করুন কেন এমন হল ? নিজের দোষ অন্যের ঘারে চাপিয়ে দেয়ার মনোভাব পরিহার করুন।
(১০) সর্বোপরি মনে রাখবেন অভিজ্ঞতার বিকল্প কিছু নেই।

Related product you might see:

Share this product :

Post a Comment